অধ্যাপকের জাতবিচার

গত নভেম্বর মাসে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি৷

অনেকের হয়ত মনে পড়বে, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র একটা বিক্ষোভে সামিল হয়েছিলেন একজন অধ্যাপকের পদত্যাগের দাবিতে৷ প্রথমে মনে হয়েছিল ছাত্ররা নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম রক্ষার্থে কোনও অযোগ্য শিক্ষক, যিনি কোনও নেতা–মন্ত্রীর হাত ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন তাঁর পদত্যাগের দাবিতেই ছাত্ররা আন্দোলনে৷ ভাল লাগছিল এই ভেবে যে এখনও এদের মেরুদণ্ড সোজা রয়েছে, অন্যায়ের কাছে আপস করতে শেখেনি৷ কিন্তু খবরের ভেতরে গিয়ে দেখলাম, ছাত্ররা লড়ছেন এই জন্য যে ওই অধ্যাপক একজন মুসলিম হয়েও কোন অধিকারে সংস্কৃত বিভাগে অধ্যাপনা করবেন? মনটা ব্যথায় ভরে গেল৷ ছোটবেলার স্কুল জীবনের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল৷ জন্মসূত্রে আমি উচ্চবর্ণের হিন্দু পরিবারের ব্রাহ্মণ সন্তান৷ আমাদের সময় স্কুলে একটা নিয়ম অনুযায়ী দীর্ঘ কোনও ছুটির অবকাশে আমরা ছাত্র–ছাত্রীরা শিক্ষক–শিক্ষক সবাইকে প্রণাম করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করতাম৷ শিক্ষক মহাশয়রা কে কোন জাতের, এ ভাবনার কোনও জায়গা ছিল না৷ শুধু তাই নয়, আমার খুব মনে আছে কুসুম পিসির কথা৷ কুসুম ঘড়াই, স্কুলের অশিক্ষক কর্মচারী ছিলেন৷ তিনি কিছুতেই আমার প্রণাম নেবেন না৷ একে আমি ব্রাহ্মণ সন্তান, তার উপর প্রধান শিক্ষকের ছেলে৷ কিন্তু আমার বাবার হস্তক্ষেপেই অত্যন্ত সংকুচিত হয়েই কুসুম পিসিকে প্রণাম গ্রহণ করতে হত৷ এই তো প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতি অথচ এই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক বলে যাঁরা ঘোষণা করে চলেছেন, সেই অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের যাঁরা সদস্য, তাঁদের এ কী আচরণ

রাতে ঘুম এল না৷ একে একে মনে পড়ে গেল অতীত ইতিহাসের কথা৷ ১৯৩৯ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সংগ্রহের জন্য পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য ও আবুল কালাম আজাদ গিয়ে হাজির হয়েছেন হায়দরাবাদের নিজামের দরবারে৷ তখন নিজাম মির ওসমান আলি খান৷ দেশের প্রথম বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সেদিন এক লক্ষ টাকা দান করেছিলেন তিনি৷ যদিও এর কিছু দিন বাদে তিনিই আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দান করেছিলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা৷ তা ছাড়াও বেনারস সহ বহু হিন্দু মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষেণের জন্য নিয়মিত দান করতেন তাঁরা৷ এখানেই শেষ নয়, ১৯৬৫ সালে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ওই নিজাম দান করেছিলেন ৫০০০ কেজি সোনা৷ আজ যারা দেশপ্রেমের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা সেদিন ব্রিটিশদের পদলেহন ছাড়া আর কী ভূমিকা পালন করে ছিলেন আমার জানা নেই৷ বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই এই ইতিহাস সামনে আসা দরকার৷

তমাল নন্দ, কলকাতা